প্রাচীন জনপদ গলসি

রাঢ় বাংলার মধ্যমণি বর্ধমান জেলার এক প্রাচীন জনপদ গলসি।এই অঞ্চলের জনজীবন ঐতিহাসিকতা, সংস্কৃতিগত বৈচিত্র ও লোকায়ত ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ। চৈনিক পপর্যটক হিউয়েন সাং তাঁর গ্রন্থে গলসি অঞ্চল কে ' উতুপ্রদেশ ' নামে চিহ্নিত করেছেন।
গলসি অঞ্চলের নামকরণ কিভাবে হলো তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।অনেকে বলেন গ্রাম্য দেবতা গর্গেশ্বর শিবের নাম থেকে গ্রামের নাম হয়েছে গলসি,ডঃ সুকুমার সেন মনে করেন 'গলশাশী' শব্দ থেকে গলসি নাম এসেছে;বহু পূর্বে এ অঞ্চল ছিল গভীর শাল বনের জজ্ঞল,তখন ঠ্যাঙারেরা পথচারীদের হত্যা করে সে জজ্ঞলে পথের দুপাশে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখতো সেই গলায় রসি থেকে গলসী নাম হয়েছে।অনেক গবেষকে মত সামন্ত রাজা ময়গল সিংহের নাম থেকে অঞ্চলের নাম হয়েছে গলসি।
গলসি অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মল্লসারুল গ্রামে জারুল নমক এক পুকুরে মাটিতোলার সময় পাওয়াযায় বঙ্গদেশের প্রাচীনতম তাম্রপট্ট লিপি ' মল্লসারুল লিপি ',যেটি আসলে একটি ভূমিদান পত্র।ননীগোপাল মজুমদারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এতে পাশাপাশি বেশ কিছু গ্রামের সসম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরগণের কাছ থেকে কিনে তা কৌণ্ডিন্য গোত্রের ব্রাম্ভণ বৎসস্বামীকে প্রদান করা হয়েছিল।এখানে উল্লেখিত মহারাজ বিজয়সেনের রাজত্ব কাল৫০৭-৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দ। বর্ধমান জেলার ইতিহাসে এই লিপির তাৎপর্য ব্যাপক,মল্লসারুল লিপিতেই প্রথম বর্ধমান ভুক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়।এই লিপিতে উল্লেখিত কিছু গ্রামের প্রাচীন নাম পাওয়া যায়,যেমন- মল্লসারুল>আম্রগর্তিকা,কইতাড়া>কবিন্থবাটক,মহড়া> মধুযাটক,আদড়া>অধিঝকরক,বাকতা>বককক্ততক ইত্যাদি।
খানো গ্রামে বাঘা রাজাদের ঢিবি থেকে কিছুদিন আগে আবিস্কৃত হয়েছে প্রায় দুহাজার বছর পূর্বের মাটির পাত্রের বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ। জগৎরায় মুঘল সম্রাট আলমগীরের কাছথেকে যে ৪৯ টি মৌজার জমিদারিত্ব পেয়েছিলেন সেখানে ' বাঘাপরগনা ' বলে গলসির উল্লেখ আছে।খানোতে এই বাঘারাজবাড়ি যাবার ছিল দুটো পথ,যেটি প্রধান মোড় ছিল সে মোড়ে গড়েউঠা গ্রামটির বর্তমান নাম' বড়োমাড়',আর অপেক্ষ্যাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ গ্রামটির নাম ' ছোটমোড় '।
মূল গলসি গ্রামে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য শিবের শিখর দেউল ও দুর্গামন্দির।গ্রামের একেবারব মাঝখানে আছে আটকোনা শিবমন্দিরে গ্রাম্য দেবতা গর্গেশ্বর,এছাড়াও পাড়ায় অন্যেক দালান মন্দিরে আছে ধর্মরাজের শিলামূর্ত; শ্রাবণ মাসে গ্রামে ধর্মরাজ ও গর্গেশ্বরের গাজন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়।এই গাজনের এক ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য আছে,গ্রামের মিড়িকপাড়ার মসজিদের সামনে ছাড়া এ দেবতা পূজা নেন না,যা হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির এক উজ্বল দৃষ্টান্ত।
ধর্মঠাকুর ক্ষেত্রপালের নাম অনুসারে 'ক্ষেত্রপুর ' থেকে খেতুড়া গ্রামের নাম হয়েছে,খানো গ্রামের ঈশান কোণে রেললাইনের ধারে দেবী ঈশানচণ্ডীর থান,উড়ো গ্রামে পাঠান ও মোগল যুগে পথিকদের বিশ্রামস্থল রুপে ব্যবহৃত হত বলে ' চটি ' নামে পরিচিতি লাভ করেছে,এই উড়ো গ্রামে রয়েছে রায় পরিবার প্রতিষ্ঠিত দুর্লভ সিংহবাহিনী মহিষাসুর মর্দিনী জয়দুর্গার বিগ্রহ,কালাচাঁদ নামে ধর্মরাজের গাজনও হয় গ্রামে।বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় পুষ্ট ইড়কোনা গ্রামে প্রতি বছর রাধাকৃষ্ণের স্মরণে মেলা বসে।গোহগ্রামের প্রাচীন দেবকীর্তি হলো ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত চক্রবর্তী পরিবারের দালান মন্দির,মন্দিরে আছে রাধাদামোদারের শালগ্রাম শিলা,মন্দির গাত্রের টেরাকোটার সৌন্দর্য খুবই আকর্ষণীয়।আদরেশ্বর শিবের নাম থেকে গ্রামের নাম হয়েছে আদড়াহাটি,আদরেশ্বর শিবলিঙ্গটি খুবই প্রাচীন ও বিরল ধরনের।পিতল কেন্দ্রিক দ্রব্যসামগ্রীর জন্য কৈতাড়া গ্রাম বিখ্যাত,কুরকুবা গ্রামে দালান মন্দিরে কমলা নামে মনসাদেবীর পাষাণ মূর্তি, পুজো উপক্ষে প্রতি বছর শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মেলা বসে,গ্রামের মাজেদ মোল্লা নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে জলসেচের দুনি ও আখমাড়াই কল তৈরী করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
সাঁকো গ্রামে আছে সূর্য মূর্তি ঊষাদিত্য,প্রথম মহাভারতের ইংরাজী প্রকাশক (১৮৪১) শ্রদ্ধেয় প্রতাপচন্দ্র রায় ছিলেন এই গ্রামেরই বাসীন্দা।মধ্যযুগের বিখ্যাত শাক্ত কবি সাধক কমলাকান্ত থাকতেন চান্না গ্রামে,আবার মানিকতলা বোমা মামলার অন্যতম সংগঠক ঋষি অরবিন্দের সহযোগি যতীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় বা স্বামী নীরালাম্বের আশ্রম এই চান্নাতের খড়ি নদীর তীরে অবস্থিত।অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকের বিখ্যাত নারী পণ্ডিত রুপমঞ্জরী ছিলেন মারো কোটা গ্রামের বাসীন্দা।'শনিবারের চিঠি' পত্রিকার সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের জন্মস্থান বেতালবন গ্রামে।
গলসি অঞ্চলের ইসলামী ঐতিহ্যপূর্ণ নিদর্শন গুলির মধ্যে উল্লেখ যোগ্য ভুড়ি গ্রামে রয়েছে প্রায় পাঁচশো বছরের প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ, আদড়াহাটি গ্রামে ও জাগুলিপাড়া গ্রামে তিন গম্বুজ ওয়ালা প্রাচীন মসজিদ।সিমনোড় গ্রামে পীর গরীব দান বাবা,স্টেশন রোডে হজরত বাবর আলী শাহ এলাকার উল্লেখযোগ্য পীর আউলিয়ার মাজার।
রাঢ বঙ্গের লোকসংস্কৃতির প্রায় সব অঙ্গ উপাঙ্গ গুলিই এ অঞ্চলে দেখাযায়-ভাদু,তুসু,লেটো,ভাসানের গান,সত্যপীরের পালা ইত্যাদি লোকো ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ গলসি।

Comments

Popular posts from this blog